67Th pOsT : দশম পর্ব



“There is a face beneath this mask, but it isn’t me. I am no more that face than I am muscles beneath it, or the bones beneath that.”
                                                                                                            -Steve Moore, V for Vendetta.

মাইজপাড়ার গরুর হাট থেকে আমি এখন বিছানায়, কড়িবরগার দিকে তাকিয়ে।স্বপ্নের উড্ডীনতা আসে আমাকে ভাসায়।


সে ছিল নৈবেদ্য আমার। চারুকলাকেন্দ্র। রোববার বেলা করে স্নান শেষে ড্রয়িং বোর্ড ও উটের প্যাস্টেল বাক্স নিয়ে হাঁটা দিতাম।
অনেক দিন ধরে মুখ আঁকা শিখছিলাম। মুখ আঁকতে কী লাগে? দুটোতো চোখ, একটা নাক, নাকের নীচে একজোড়া ঠোঁট আর তাদের দুদিকে, তির্যক ওপরে, দুটো কান। চোখ দুটো প্রতিষ্ঠা পেলে তবে ভ্রূ, নাকি, ভ্রূযুগল প্রতিষ্ঠা পেলে তবে মুখ!
যখন মুখ ঠিক মুখের আদল পেতনা, চুলে কায়দা দিতাম। জুলপি আর গোঁফে একটু তা।

কিন্তু সব মুখ এক হয়ে যেত। ঠিক আমার মতো। এক, অন্য নয়।
তবে অন্য মুখ কিভাবে আঁকা যায়? যা একের মধ্যে মহু আবার বহুর মধ্যে এক হবে...

এরকমই আমি তখন বয়স ৬- ৭, কোনো একটা মেলায়, সম্ভবত প্রথম সমুদ্র দেখতে যাওয়ার সময়, সেই যে রাস্তায় একটা দীর্ঘ যানজট পেরোতে আমার বাপের ছোটো ভায়রা, আমার মায়ের ছোটো বোনকে বলল, তুমি শুয়ে পর, জানলার ধার ঘেঁষে, আর আমাকে, তুমি হাওয়া করো বাপী, বলে আমাদের অ্যাম্বাসাডারটা এঁকেবেঁকে, কী ভাবে যেন এপাশ ওপাশ কাটিয়ে- সেবারই প্রথম মুখোশ দেখেছিলাম। ঠিক কীরকম ছিল? তাল গাছের শরীরে ঝুলছিল। অনেকগুলো তাল গাছে অনেকগুলো মুখোশ। লম্বাটে দাঁড়ি, চোখগুলো মুখের বাইরে টানা টানা বেরিয়ে এসেছে। টিকালো নাক, যা পরবর্তী সময়ে আমার অনার্য উৎপত্তি সম্পর্কে আমাকে আরো বেশি বিশ্বস্ত করে তুলবে। আর পুরু মোটা ঠোঁট। মেয়েদের কোয়া ফলে আছে। কানে দুল। তারের প্যাঁচানো। রূপো জলে রঙ করা।

এরপর থেকেই মুখোশ আমাকে পেয়ে বসল। মুখ আঁকা কঠিন কিন্তু মুখোশ বেশ সোজা। যেমন তেমন। আর ততদিনে বেশ বুঝেছি, খুব প্রতিসাম্য রক্ষা করতে হয় না। আদল মেনে চলতে হয় না। এদিক ওদিক মেরামতি করে দিলে দাঁড়িয়ে যায়। কী দাঁড়ায়?
তখন আরেকটু বড়। ৭ অথবা ৮ ক্লাস। রুবী কাকিমার শোবার ঘরের দরজায় একজোড়া মুখোশ ছিল। আদিবাসী নারী ও পুরুষ। খুব রুক্ষর মধ্যে একটা সৌন্দর্যপ্রতিম ছিল। রুবী কাকীমার ভারি বুকের মধ্যে আলো আর তাপ ধাপে ধাপে নামছিল। সেই প্রথম নাক ডুবিয়ে আর রুবী কাকীমা আমার চুলে মুখ ঘষতে ঘষতে, আমার শরীরে হাত আর পা ঘষতে ঘষতে, আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
আমি খাতার ভাঁজে রুবী কাকীমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতাম। মনে পড়ে রুবী রায়, তোমার এইসব, এখন তুমি, যেমন শুনেছি, দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ার নিয়ে বসে থাকো, নীচেও নামো না। সেদিন তো আমার সব আর আমাকে তলায়, যত দূর তলানো যেতে পারে, ততদূর নামিয়েছিলে।

তাহলে এসব কথা এখন কোথা থেকে বলছি? আমার প্রায় ঘন জোড়া ভ্রূর নীচে, ঠিকরে পড়া দুটো চোখের তলায়, একটা প্রায় চাপা নাক আর যে ঠোঁট দুটো ঠেলে উঠেছে, তাদের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে নিঃসৃত হচ্ছে আমার সেই প্রথম চৈতন্য প্রবাহ।

মা জিজ্ঞাসা করেছিল, কি রে কী কামড়েছে, ঠোঁট ফুলে ঢোল...

তারপর থেকেই তো প্যান্ডরার বাক্স খুলে গেল। এদিক ওদিক থেকে শুধু হুল আর হুল। আমার খালি চাবির ফাঁপা উর্ধ্ব মুখ। কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। উর্ধ্ব মুখের মুখ শব্দটা এসেই মেলালো।

সেই কবে স্কুল ফেরত, কলেজস্ট্রীট ফেরত, সরস্বতীর বায়না দেব বলে কুমোরটুলি এসেছি। আমার কোনো দৈব দায় নেই, কখনো ছিল না। কিন্তু পুজো কমিটির সেক্রেটারি। বিশেষ উদ্দেশ্যে। বারো ক্লাসের ও স্কুল ছেড়ে যারা উল্টো দিকের কলেজটায় ঢুকেছে তাদের প্রীতি ও আস্থাভাজন। সেবার শ্রম ও শ্রমের হাতিয়ারের মাধ্যমে মানুষের বিবর্তন- পোস্টার এক্সহিবিশান হবে। মার্কস- এঙ্গেলস-র প্রমাণসাইজ কাট আউট থাকবে। উত্তেজনায় টানটান।
সরকারী স্কুলের একতলার টিচার্স রুমের মাস্টারমশাইরা ভয়ংকর নিরুৎসাহ, দোতলাররা বাহ, বাহ! ও তিনতলাররা উদাসীন ও সাবধানবাণী করেছিলেন। ততদিনে আমার মুখ অন্যমুখের আদল ছুঁয়ে গেছে।
একতলাররা রীতিমতো পুজো বয়কট করলেন, দোতলাররা প্রত্যক্ষ ও তিনতলাররা পরোক্ষ সমর্থন জোগালেন।
সেবার সরস্বতীর বুকে হাত রেখেছিলাম। আর ভাস্বতী এসেছিল। ওকে বলেছিলাম। ও রেকর্ডবুকে ব্রাভো শব্দটা লিখে দিয়েছিল। কোন প্রদর্শনের জন্যে, ওকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
আমি পরদিন, স্কুলের বাঁধানো চত্তরে, শীতের মুখ নয়, বিবর্ণ হলুদ, লাল ও খয়েরি ক্ষত ও নিরাময়হীন মুখোশ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।

আমি যখন দশ ক্লাসে, ভাস্বতী এগারোতে। ওকে লুকিয়েছিলাম। একদিন ধরা পড়লাম। আর কত কর্ণকুন্তী সংবাদ মুখস্থ করব। ক্রমে জেনে ও বুঝে বলব, কৌরব কৌরব থাক পান্ডব পান্ডব অর্থে কর্ণের তৃতীয় বিচ্ছিন্ন ও উভয় মেরু থেকে সমদূরত্ব অঙ্কন,... ইনকিলাব জিন্দাবাদ... জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ... প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক...
কমঃ পার্থ দে, মাটির ভাঁড়ে লিকার আর লাল সুতোর বিড়িতে টান দিতে দিতে বলল, এই বইটা তোকে পড়তে দিলাম, Artistic Creativity, Reality and Manলুকিয়েই দিলাম। লুকিয়েই ফেরত দিবি।
এটাই কি ডায়ালেক্টিক? মানছি না... মানব না।


ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্যের দাবীতে উত্তাল কলেজস্ট্রীট। আমার প্রিয় রঙের নাম যেই বলেছি... বলতে বলতে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি, অমনি তাঁরা বিঁধিয়ে দিল তিনটে তরোয়াল, সেও একযুগ হল। ঠিক করেছিলাম কি আমরা? ঝাড়খন্ডিদের ঝাড়খন্ডে এখন গো-বলয়ের প্র-চন্ড ও প্র-কান্ড দাপট। মুখোশ বলল, ঠিক ভুল কিছুই করিস নি। একটি নির্দিষ্ট কালে একটাই নির্দিষ্টস্থানাঙ্কে দাঁড়ানো যায়।

জড়ভরত ফতোয়া দিয়েছিল বাজারী পত্রিকায় যারা লিখবে, ছোটো পত্রিকায় তারা লিখতে পারবে না। মানে, লেখা উচিৎ নয়আমি বলেছিলাম, যারা বহু বছর লেখার পর এই অনুশোচনা করে, তাদের ক্ষমা চেয়ে সম্পাদকীয় লেখা উচিৎ। সেইতো একই মানছি না, মানব না। যেকোনো রেজিমেন্টেশান- ই ব্যক্তি মুখের কথা বলে না। একটা আপাত সমষ্টি সুখ ও সঙ্গ দেয় ততদূর, যতদূর বলিরেখা পড়ে না।

আর তার কী হল? যে এই সবকিছু নিয়ে আমার হাত ধরে হেঁটেছিল?

সে অন্য কারো হাত ধরে নিয়েছে, মুখোশ বলল, সেই স্থান ও কালের মহিমা মাত্র আর একটা অন্তরফল, এই সব গুঁড়ো গুঁড়ো স্মৃতিকণা যা এখন পদ্মপাতায় চলকে যাচ্ছে।

কী বাজে একটা সরলীকরণ!
তাই আমি এখন মুখোশ আঁকি। তাতে জল রঙ দিই। আর জলকে চলি, উভয়েই ভাসতে ভাসতে যাই।
একটা জলচক্র।
মুখ ও মুখোশ।

কি ভাইগ্ন্যা, উঠবে না! আজ বখরী ঈদ, আমরা তো ইণ্ডিয়ায় যাব। তুমি কি ঠিক করলে? ফরিদপুরের দিকে যাবে না এখানেই আর দুটো দিন কাটিয়ে দাও... তারপর ধীরে সুস্থে যেও...